ইউক্রেনে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে রাশিয়া। এ যুদ্ধে নিজ দেশের মানুষের সমর্থন বেশি দরকার দেশটির। এটা করতে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের ওপর চাপ বাড়িয়ে চলেছে ক্রেমলিন।
গতকাল মঙ্গলবার রাশিয়ার স্বাধীন সংবাদমাধ্যম -এর এক বিশেষ প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে
খবরে বলা হয়েছে, সাইবেরিয়ার বুরিয়াটিয়া অঞ্চলের ইংরেজি শিক্ষক ইয়েলেনা বাগায়েভা। তিনি স্কুলে যুদ্ধসহ বিভিন্ন খবরের প্রধান প্রধান শিরোনাম নিয়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনা করেন। ইয়েলেনা মার্চের একটি আলোচনার কথা তুলে ধরেন স্থানীয় গণমাধ্যমের কাছে। তিনি বলেন, ওই সময় তিনি শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের বোঝাতে চাইছিলেন, যেকোনো যুদ্ধই খারাপ। তোমরা ইউক্রেনীয়দের মৃত্যু কামনা বা তাদের ঘৃণা করতে পারো না। তারাও আমাদের মতোই মানুষ। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনার এই ঘটনা সপ্তম শ্রেণির এক ছাত্র রেকর্ড করে। পরের দিন ওই শিক্ষার্থীর মা ভিডিওটি দেখিয়ে স্কুল কর্তৃপক্ষ ও পুলিশের কাছে ইয়েলেনার বিরুদ্ধে নালিশ করেন। তাঁর বিরুদ্ধে রুশবিরোধী প্রচারের অভিযোগ আনা হয়।
ইয়েলেনা বাগায়েভার (৩১) বিরুদ্ধে রাশিয়ার সশস্ত্র বাহিনীকে বদনাম করার অভিযোগ আনা হয় এবং ৪০ হাজার রুবল জরিমানা করা হয়। ইউক্রেনে রুশ হামলা নিয়ে কোনো অপপ্রচার চালানো হলে সম্প্রতি শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার যে আইন করা হয়েছে, ইয়েলেনা তার অধীনেই এ শাস্তি পেয়েছেন।
গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে হামলা শুরুর পর একে বিশেষ সামরিক অভিযানবলে প্রচার করছে ক্রেমলিন। একই সঙ্গে যুদ্ধের পক্ষে জনসমর্থন তৈরিতে সমাজের সর্বস্তরে বার্তা ছড়ানো হয়। এমনকি শিশু শ্রেণির শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোও এর বাইরে নয়।
যুদ্ধের বিরোধিতা করে প্রায়ই স্কুলের কর্মী, শিক্ষার্থীদের অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের শাস্তির মুখোমুখি হতে হয় বলে মস্কো টাইমস-এর সাক্ষাৎকারে দাবি করেন শিক্ষক ও অভিভাবকেরা। ক্রেমলিন সমালোচক অ্যালেক্সি নাভালনির আন্দোলনের সমর্থক টিচার্স অ্যালায়েন্স ইউনিয়নের প্রধান দানিল কেন বলেন, ‘আমরা যেটাকে যুদ্ধের পক্ষের প্রচার মনে করছি, সেটা সারা দেশের বেশির ভাগ স্কুলে চালানো হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম দেখলে যে কেউ ধারণা করতে পারবেন যে রাশিয়ার ৯৫ শতাংশ স্কুলে ইউক্রেন যুদ্ধের প্রতি সমর্থন রয়েছে।’
কেন আরও বলেন, ইউক্রেন আক্রমণের সময় পুতিনের দেওয়া বক্তব্যের ভিডিও মস্কো ও বাসকরতোস্তান অঞ্চলের স্কুলের শিক্ষার্থীদের কাছে রয়েছে।
নাম প্রকাশ না করে একজন স্কুলশিক্ষক বলেন, তাঁদের স্কুলের সব শিক্ষককে যুদ্ধের সমর্থনে শিক্ষার্থীদের নিয়ে ক্লাস বৈঠক আয়োজন করতে বলা হয়েছে। কোনো শিক্ষক যদি তা করতে ব্যর্থ হন, তবে অন্য শিক্ষক তা আয়োজন করবেন। এ ব্যত্যয় হওয়া চলবে না। তবে স্কুলটির অধ্যক্ষ ক্ষমতাসীন ইউনাইটেড রাশিয়া পার্টির সদস্য। তিনি দাবি করেন, তাঁদের স্কুল অরাজনৈতিক।
তবে ওই শিক্ষক আরও বলেন, স্কুলে যদি কোনো ধরনের যুদ্ধবিরোধী পোস্টার, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট বা শিক্ষার্থীদের মধ্যে আলোচনার সূত্রপাত হয়, তবে তা শুরুতেই প্রতিরোধ করা হয়।
দানিল কেন বলেন, রাশিয়ার কেন্দ্রীয় আইন অনুযায়ী, রাষ্ট্র-অনুমোদিত কর্মসূচির মাধ্যমে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হয়। তাতে বিশেষ সামরিক অভিযানসংক্রান্ত কিছু বলা নেই। তাই শিক্ষকের জন্য এ বিষয়ে পড়ানো বাধ্যতামূলক নয়। ফলে এ ধরনের পঠনপাঠনের জন্য অনানুষ্ঠানিক নির্দেশ দেওয়া হয়। কিছু শিক্ষককে অন্য উপায়ে চাপ দেওয়া হয়েছে। টিচার্স অ্যালায়েন্স প্রতি সপ্তাহে ১০ থেকে ১৫ জন শিক্ষকের চিঠি পাচ্ছে, যাঁরা যুদ্ধবিরোধী মনোভাবের জন্য চাকরিচ্যুত, চাকরি ছাড়ার চাপ ও জরিমানার শিকার হয়েছেন। তবে প্রকৃত সংখ্যা এর বেশি হতে পারে।
কিছু শিক্ষককে যুদ্ধবিরোধী দৃষ্টিভঙ্গি ও শিক্ষার্থীদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নজরদারি করে যুদ্ধবিরোধী আধেয় নিয়ে প্রতিবেদন দিতে অস্বীকৃতি জানানোর কারণে বরখাস্ত করা হয়েছে। তাঁদের একজন রেভদা অঞ্চলের উরালস শহরের ভাষা ও সাহিত্যের শিক্ষক নাতালিয়া আলেকসান্দ্রোভা। তবে যুদ্ধের সমর্থন না করায় শিক্ষকদের চাকরিচ্যুতি করার চেয়ে আরও বড় শাস্তির ঘটনাও রয়েছে। আর সেটা হলো কারাদণ্ড।
গত মার্চ মাসে পুতিন একটি আইনের অনুমোদন দিয়েছেন, যাতে বিশেষ সামরিক অভিযান নিয়ে ভুয়া খবর ছড়ালে বা ক্রেমলিন অনুমোদিত নয় এমন তথ্য শেয়ার করলে ১৫ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড হতে পারে। শিক্ষার্থীদের কথোপকথনও এর আওতার মধ্যেই পড়ে। গত মাসে পেনজা শহরের ইংরেজি শিক্ষক ইরিনা জেনের বিরুদ্ধে ভুয়া খবর ছড়ানোর অভিযোগে মামলা হয়েছে। জেন শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের কী শিখিয়েছেন, তার রেকর্ডিং ধরেই এ মামলা করা হয়। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হলে ১০ বছরের কারাদণ্ড হতে পারে। এ ধরনের অনেক ঘটনা ঘটেছে বলে দাবি করেন কেন।
তবে যুদ্ধে সমর্থন দেওয়ার চাপ শিক্ষকদের পাশাপাশি অভিভাবকদেরও নিতে হচ্ছে।