মৌলভীবাজার শহরের চৌমোহনা চত্বরে প্রতিদিন সকালে ভাসমান শ্রমিকের হাট বসে।
সকালে আড়মোড়া ভাঙার আগেই শ্রমিকদের উপস্থিতিতে এলাকাটি সরব হয়ে ওঠে। সময় যতই গড়ায়, শ্রমিকদের সংখ্যাও তত বাড়তে থাকে। সকাল নয়টার মধ্যে আবার ভিড় কমে যায়। বিভিন্ন স্থান থেকে আসা লোকজন দৈনিক চুক্তিতে এখান থেকে শ্রমিক নিয়ে যান।
গত দুই মাস ধরে পরিস্থিতি অনেকটাই বদলে গেছে। শ্রমিকদের সকালে আসার সময়টা ঠিক আছে। তবে কাজে যাওয়ার নিশ্চয়তাটা আর নেই। অনেকেই সকাল ১০টা থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত কাজের অপেক্ষায় বসে থাকেন। কাজ না পেয়ে টুকরি-কোদাল কাঁধে ঝুলিয়ে অনেকেই এখন খালি হাতে ঘরে ফিরে যান।
এক দিন কাজ পেলে তিন দিন আর কাজ মিলে না। এক দিন কাজ করে ১০ দিনও কাজ পাননি—এমন মানুষও আছেন।
আজ শুক্রবার সকাল সাড়ে আটটার দিকে চৌমোহনা চত্বরের চারদিকে বিভিন্ন দোকানের বারান্দা, ফুটপাতে টুকরি-কোদাল নিয়ে বসেছিলেন একদল শ্রমিক। এত বেলায় সাধারণত এখানে এক শ্রমিক বসে থাকেন না। তাঁরা তখনো কাজের অপেক্ষায় আছেন। তাঁদের মধ্যে একজন হবিগঞ্জের লাখাইয়ের রেনু মিয়া। প্রায় চার বছর ধরে মৌলভীবাজারে শ্রমিকের কাজ করেন তিনি। এত দিন দিনমজুরের কাজ করে টেনেটুনে সংসার চলত। এ নিয়ে তেমন কোনো আফসোস ছিল না। কাজ করে যা মজুরি পেতেন, তা দিয়ে সংসার চলত। তবে এখন আর চলছে না।
রেনু মিয়া বলেন, ‘দুই মাস ধরে বেশি খারাপ অবস্থা। ১০ দিন আগে ১ দিন কাজ পাইছলাম। আর কাজ নাই। প্রতিদিন আই (আসি)। টুকরি-কোদাল লইয়া ডিউটি দিয়া যাই।’
শ্রমিকরা জানিয়েছেন, এখানে মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, ময়মনসিংহ, ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ আশপাশের বিভিন্ন এলাকার মানুষ আছেন। তাঁরা সবাই মৌলভীবাজারে থেকে শ্রমিকের কাজ করেন। প্রতিদিন সকালে চৌমোহনা চত্বরে ৫০০ থেকে ৬০০ শ্রমিক এসে ভিড় জমান। মাটি কাটা, নির্মাণকাজসহ বিভিন্ন ধরনের কাজ করতে পারেন এই শ্রমিকেরা। কাজের ধরন অনুযায়ী ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা করে মজুরি পেয়ে থাকেন।
হবিগঞ্জের চুনারুঘাটের আলতা মিয়া প্রায় চার বছর ধরে মৌলভীবাজারে থাকেন। এই শ্রমিক হাটের একজন নিয়মিত সদস্য তিনি। প্রথম আলোকে বলেন, ‘দুই মাসের মধ্যে পাঁচ দিন কাম করছি। সংসারে পাঁচ-ছয় জন মানুষ। কাজ নাই। সংসার কেমনে চলব। ৫০ থেকে ৬০ টাকা চাউলের কেজি। পেটেও ভাত নাই। উপাস-কাপাস থাকা লাগে। আমরার লাগি মরণ আইছে।’
চুনারুঘাটের তারেক রহমান বলেন, ‘বাঁচার লাগি যখন যেতা (যা) পাই কাজ করি। কিন্তু এখন কাজই নাই। সকাল ৯টা থেকে ১০টা পর্যন্ত অপেক্ষা করি। এরপর কোদাল লইয়া (নিয়ে) ফিরত যাই।’
এই হাটের অধিকাংশ শ্রমিকেরই একই অবস্থা। অনেক শ্রমিক অনেকটা দূর থেকে আসেন। কাজ না পেলে আসা-যাওয়ার ভাড়া শোধ করা নিয়ে বিপাকে পড়েন তাঁরা। অনেকে বিভিন্ন এনজিও থেকে ঋণ নিয়েছেন। সেই ঋণের কিস্তি শোধ করতে পারছেন না। সংস্থার লোকজন বাড়ি এসে তাগাদা দিচ্ছে। একদিকে ঘরে খাবারসংকট, অন্যদিকে ঋণ শোধের তাগিদে অনেকেই দিশেহারা।
মৌলভীবাজারের রাজনগরের শাহনাজ আলী বলেন, ‘প্রতিদিন আইতে-যাইতে ৬০ টাকা লাগে। কাম না পাইলে এই খরচও উপরে পড়ে।’
কাজ না থাকার কারণটা তাঁদের কারও কাছে স্পষ্ট নয়। তবে বেশ কয়েকজন শ্রমিকের ধারণা উন্নত প্রযুক্তির কল্যাণে তাঁদের কাজের চাহিদা কমে গেছে। তাঁদের মতে, আগে যে কাজে অনেক শ্রমিক লাগত, যন্ত্রপাতির ব্যবহার করে অনেক কম শ্রমিক নিয়ে কাজটি করা যাচ্ছে। এ কারণে অনেক শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েছেন।
লেচু মিয়া বলেন, ‘মাটি কাটার মেশিন বাইর করছে। ১০০ জনের কাম এক ঘণ্টায় করিলায় (করে ফেলে)। ধান কাটার মেশিন বাইর করছে। ধান কাটাতর একটা গেরস্ত মানুষ আয় না। গরিব মারার মেশিন বাইর করছে। সরকার আমরার মতো গরিব অইলে অবস্থাটা বুঝতো। মাইনসে দিনে তিনবার ভাত খায়, আমরা একবার খাইয়া জান বাঁচানো দায় অইছে।’