বছর বছর বাজেটে অর্থ বরাদ্দ

নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ করা হবে—সরকার এই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে ২০১২ সালের জুলাইয়ে। প্রকল্প বাস্তবায়নে বছর বছর যে অর্থের প্রয়োজন হবে, তার জোগান দেওয়ার নিশ্চয়তা পাওয়া যায় সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে। ফলে পদ্মা সেতুর কাজ শুরু করতে আর কোনো বাধাই রইল না।

 

বিশ্বব্যাংকসহ অন্য ঋণদাতারা পদ্মা সেতু প্রকল্পের অর্থায়ন থেকে যখন নিজেদের সরিয়ে নেওয়ার ঘোষণা দেয়, তখন সেতু তৈরি খানিকটা অনিশ্চয়তায় পড়েছিল। সরকার নিজেদের অর্থায়নে সেতুটি তৈরির উদ্যোগ নেওয়ার পর মন্ত্রিসভার সদস্য, সংসদ সদস্য, সরকারি কর্মচারী ও সাধারণ মানুষের মধ্যে সেতু নির্মাণের বিষয়ে আবেগ প্রকাশ করতে দেখা যায়। অনেকেই অনুদান দিতে আগ্রহ দেখান।

২০১২ সালের আগস্টে সরকার দুটি ব্যাংক হিসাব খোলে, যেখানে সরাসরি অনুদান জমা দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সংগঠনগুলো এক দিনের বেতনের সমপরিমাণ অর্থ অনুদান হিসেবে দেওয়ার ঘোষণা দেয়। মন্ত্রী-সংসদ সদস্য, সচিবেরা বেতনের অংশ দান করার কথা জানান। অবশ্য পদ্মা সেতুর জন্য এভাবে তহবিল গঠনের বিষয়টি তেমন একটা এগোয়নি। সরকারও পরে এ বিষয়ে আগ্রহ দেখায়নি। বরং বাজেট থেকে অর্থ বরাদ্দ দেওয়ার দিকেই যায় সরকার।

উল্লেখ্য, ২০১১ সালের অক্টোবরে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগ এনে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু প্রকল্পে অর্থায়ন স্থগিত ঘোষণা করে। যদিও পরে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তদন্তে দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়া যায়নি। কানাডার আদালত দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের বিষয়ে উপযুক্ত প্রমাণ পাওয়া যায়নি বলে জানান।

অর্থ

২০১৩ সালের ৩১ জানুয়ারি সরকার চিঠি দিয়ে বিশ্বব্যাংককে জানিয়ে দেয় যে পদ্মা সেতুর জন্য ঋণ নেওয়া হবে না। অর্থাৎ আনুষ্ঠানিকভাবে বিদেশি ঋণের পর্ব শেষ হয়ে যায়, শুরু হয় নিজস্ব অর্থায়নে সেতু নির্মাণের পালা। শুরু থেকে পদ্মা সেতু প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত কর্মকর্তারা বলে থাকেন, প্রকল্পের কাজ বিশ্বব্যাংকসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো যেখানে রেখে গেছে, সেখান থেকেই শুরু করে সরকার। শুধু অর্থায়নে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর বদলে নিজস্ব অর্থায়ন যুক্ত হয়েছে। অর্থাৎ মূল কাজের ঠিকাদার নিয়োগ, নির্মাণকাজ, কাজের তদারকি, ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন, পরিবেশ রক্ষায় উদ্যোগ—সবই আন্তর্জাতিক মানদণ্ড মেনে করা হয়েছে।

নথিপত্র অনুযায়ী, সরকার পদ্মা সেতু তৈরিতে বড় অঙ্কের অর্থ বরাদ্দ দেয় ২০১৩-১৪ অর্থবছরে, পরিমাণ ৬ হাজার ৮৫২ কোটি টাকা। এরপর প্রতি বছরই বড় অঙ্কের অর্থবরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, যা দিয়ে সেতুর কাজ হয়েছে। নির্মাণকাজ শুরুর পর তা এক দিনের জন্যও বন্ধ হয়নি।

শুরু থেকেই পদ্মা সেতু প্রকল্পের কাজ পাঁচটি বড় ভাগে (প্যাকেজে) ভাগ করা হয়েছিল। এগুলো হলো মূল সেতু, নদীশাসন, মাওয়া প্রান্তে টোল প্লাজাসহ সংযোগ সড়ক নির্মাণ, জাজিরা প্রান্তে টোল প্লাজাসহ সংযোগ সড়ক নির্মাণ এবং সার্ভিস-২ এলাকা (অফিস, ৩০টি ডুপ্লেক্স বাড়ি, ল্যাবরেটরি, মসজিদ, স্বাস্থ্যকেন্দ্রসহ অন্যান্য স্থাপনা) নির্মাণ।

অর্থ

সব কটিরই দরপত্রপ্রক্রিয়া ২০১০ ও ২০১১ সালে শুরু হয়েছিল। বিশ্বব্যাংকসহ ঋণদাতারা তদারকও করত। নিজস্ব অর্থায়নের সিদ্ধান্তের পর নতুন করে দরপত্র আহ্বান না করে এসব কাজ আগের অবস্থা থেকেই এগিয়ে নেওয়া হয়। শুধু মূল সেতু নির্মাণের পরামর্শক নিয়োগের নতুন দরপত্র আহ্বান করা হয়। কারণ, এটি নিয়েই বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে জটিলতা তৈরি হয়েছিল।

১ হাজার ৪৯৯ কোটি টাকায় মাওয়া ও জাজিরা প্রান্তে সংযোগ সড়ক এবং সার্ভিস-২ এলাকা নির্মাণের ঠিকাদার নিয়োগ পায় বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠান আবদুল মোনেম লিমিটেড। তারা সহযোগী হিসেবে নেয় মালয়েশিয়ার এইচসিএম নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে। আবদুল মোনেম কাজ শুরু করে ২০১৩ সালের অক্টোবরে। শেষ করে ২০১৬ সালে।

বিভিন্ন কাজের তদারকে চারটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ও তিনটি বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) নিয়োগ দেওয়া হয়। এর মধ্যে দুই পাড়ে সংযোগ সড়ক ও সার্ভিস এরিয়া নির্মাণে পরামর্শকের দায়িত্ব পায় সেনাবাহিনী ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)।

মূল সেতু ও নদীশাসনের কাজ তদারকের দায়িত্ব পায় কোরিয়া এক্সপ্রেসওয়ে করপোরেশন। ব্যবস্থাপনা সহায়তা পরামর্শক হিসেবে নিয়োগ পায় যুক্তরাজ্যের হাই পয়েন্ট রেন্ডাল নামের একটি প্রতিষ্ঠান।

অর্থ

মূল সেতু নির্মাণে ঠিকাদারদের প্রাক্‌-যোগ্যতা যাচাই দরপত্র আহ্বান করা হয়েছিল ২০১০ সালে। ৪২টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান অংশ নিলেও শেষ পর্যন্ত দরপত্র জমা পড়ে ১০টি। পাঁচটি যোগ্যতা অর্জন করে। এর মধ্যে চায়না কমিউনিকেশন কনস্ট্রাকশন কোম্পানি বিশ্বব্যাংকের কালো তালিকাভুক্ত থাকায় বাদ পড়ে। চারটি প্রতিষ্ঠানের কাছে কারিগরি দরপত্র আহ্বান করা হয়।

ঠিকাদারদের অনুরোধে দরপত্র জমা দেওয়ার সময়সীমা চার দফা বৃদ্ধি করা হয়েছিল। ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে তিনটি প্রতিষ্ঠান দরপত্র জমা দেয়। সবাই কারিগরিভাবে যোগ্য বিবেচিত হয়। প্রতিষ্ঠানগুলো হলো চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন কোম্পানি (এমবিইসি) এবং দক্ষিণ কোরিয়ার দুটি প্রতিষ্ঠান স্যামসাং ও ডায়েলিম-বিএম-ভিসিআই (যৌথ)। তাদের ২০১৪ সালের ৫ মার্চ আর্থিক প্রস্তাব দাখিলের আহ্বান জানানো হয়। ঠিকাদারদের অনুরোধে তিন সপ্তাহ সময় বৃদ্ধি করা হয়েছিল।

এরপরও কোরিয়ার দুই প্রতিষ্ঠান সময় বৃদ্ধির আবেদন করে। কিন্তু সরকার সময় আর বাড়ায়নি। এমবিইসি ১২ হাজার ১৩৩ কোটি টাকায় সেতুটি নির্মাণ করার প্রস্তাব দিয়ে নির্বাচিত হয়। ১৭ জুন এমবিইসির সঙ্গে সরকারের চুক্তি সই হয়। তারা ওই বছরের নভেম্বরে কাজ শুরু করে।

নদীশাসনের কাজের প্রাক্‌-যোগ্যতা যাচাই দরপত্র আহ্বান করা হয় ২০১০ সালের জুলাইয়ে। ছয়টি প্রতিষ্ঠানকে যোগ্য ঘোষণা করার পর একটি প্রতিষ্ঠান নিজেদের প্রত্যাহার করে নেয়। দুই দফা সময় বৃদ্ধির পর ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে পাঁচটি প্রতিষ্ঠান কারিগরি প্রস্তাব দাখিল করে। একটি প্রতিষ্ঠান কারিগরি যোগ্যতা অর্জন করেনি এবং আরেকটি নিজে থেকেই সরে দাঁড়ায়। ৮ হাজার ৭০৭ কোটি টাকা প্রস্তাব করে চীনের সিনোহাইড্রো সর্বনিম্ন দরদাতা হয়। ২০১৪ সালের নভেম্বরে চুক্তির পর ডিসেম্বরে তারা কাজ শুরু করে।

পদ্মা সেতু উদ্বোধন করা হবে ২৫ জুন।

 

 

রিজার্ভ বাঁচাতে পাকিস্তানিদের চা পান কমাতে বলল সরকার

করোনাশনাক্ত দেড় শ ছাড়াল, শনাক্তের হার আবার ৩-এর বেশি

Leave A Reply

Your email address will not be published.