এক রোগীতে সোয়া ২ লাখ টাকা খরচ দায় এড়াতে পারেন না চসিকের শীর্ষ কর্মকর্তারা
বিশেষ প্রতিনিধি চট্রগ্রাম | ১৮ সেপ্টঃঃ ২০২০
বিশেষ প্রতিনিধি : করোনাকালে চিকিৎসা সেবার নামে কোথাও কোথাও চলছে লুটপাট আর প্রতারণা। কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার ঘটনা এখন গণমাধ্যম দেখলেই চোখে পড়ছে। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের আইসোলেশন সেন্টারে ঘটেছে সবাইকে চমকে দেয়ার মতো ঘটনা। সেন্টারটিতে সাধারণ উপসর্গ নিয়ে আসা একেকজন করোনারোগীর পেছনে ব্যয় হয়েছে ২ লাখ ১৫ হাজার টাকা করে। অথচ ব্যক্তি উদ্যোগে গড়ে তোলা আরেক আইসোলেশন সেন্টারে একেকজন করোনারোগীর পেছনে খরচ হয়েছে মাত্র ৬ হাজার ১৭৮ টাকা! যেন রূপকথার গল্পকেও হার মানিয়েছে।
চট্টগ্রাম নগরের আগ্রাবাদ এক্সেস রোডের সিটি কনভেনশন হলে গত ২১ জুন চট্টগ্রাম সিটি করর্পোরেশনের উদ্যোগে চালু করা হয় একটি আইসোলেশন সেন্টার। আড়াই শত শয্যার আইসোলেশন সেন্টারটির উদ্বোধন করেন সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিন। চিকিৎসা নিয়ে নগরজুড়ে হাহাকারের মাঝেও সেখানে রোগী না যাওয়ায় ৫৫ দিনের মাথায় সেন্টারটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। জানা গেছে, ওই ৫৫ দিনে ১২০ জন রোগীর জন্য খরচ দেখানো হয়েছে ২ কোটি ৭০ লাখ টাকা। এ হিসেবে মাথাপিছু প্রতিজন রোগীর পেছনে খরচ হয়েছে ২ লাখ ১৫ হাজার টাকা।
জানা গেছে, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন পরিচালিত আইসোলেশন সেন্টারটি চালু হওয়ার পর সেখানে বিদ্যুৎ বিল কিংবা ভবন ভাড়াও লাগেনি। এমনকি সেখানে ছিল না আইসিইউ বা ভেন্টিলেটর সুবিধাও। অনেকটা হেলাফেলায় গড়ে ওঠা ওই নামমাত্র আইসোলেশন সেন্টারে মাত্র ৫৫ দিনে জনপ্রতি রোগীর খরচ কিভাবে ২ লাখ ১৫ হাজার টাকা হতে পারে— এ নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা এমনকি সচেতন মানুষ।
চসিকের হিসাবে আরো দেখা গেছে, ৫৫ দিনে সেখানে চিকিৎসা নিয়েছে মাত্র ১২০ জন রোগী। এতো রোগী আদৌ সেখানে চিকিৎসা নিয়েছিল কিনা— এ নিয়ে বিতর্ক থাকলেও চসিকের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী প্রতিদিন গড়ে ২ জন রোগী সেখানে সেবা পেয়েছেন। বন্দরনগরীর আগ্রাবাদে সিটি কর্পোরেশনের ওই আইসোলেশন সেন্টারের সমন্বয়কের দায়িত্বে ছিলেন যান্ত্রিক বিভাগের ভারপ্রাপ্ত তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী সুদীপ বসাক। শুরুতেই দরপত্রবিহীন ২ কোটি টাকার বেশি খরচ দেখানো ছাড়াও হিসাবের গরমিলসহ নানা অভিযোগ উঠেছে এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। সন্দেহের তীর চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা সেলিম আক্তার চৌধুরীর বিরুদ্ধেও। অভিযোগ রয়েছে, একই পদে এক যুগেরও বেশি সময় ধরে বহাল তবিয়তে আছেন। বিভিন্ন সময়ে শত কোটি টাকার নিয়োগ বাণিজ্য, স্বাস্থ্য সরঞ্জাম কেনাকাটায় কোটি কোটি টাকার দুর্নীতি করেছেন সেলিম আক্তার চৌধুরী। চট্টগ্রামের সাধারণ মানুষ চান, তাঁর অনিয়মও সরকারের খতিয়ে দেখুক। সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষা তদন্ত করুক।
নিজের বিরুদ্ধে অভিযোগের বিষয়ে কোন কথা বলেননি চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা সেলিম আক্তার চৌধুরী। তবে তিনি জানান, বর্তমান প্রশাসন দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে সিটি কর্পোরেশনের আইসোলেশন সেন্টারে অনিয়মের অভিযোগ পেয়ে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। তাদের কাছ থেকে নেওয়া তথ্য বাজারদরের সঙ্গে সামঞ্জস্য আছে কিনা তদারকি করা হবে। একই সঙ্গে বাজার কমিটির সঙ্গে তাদের তথ্যগুলো মিলিয়ে দেখা হবে। পরবর্তীতে এসব যাচাইবাচাই করার পর রিপোর্ট দেওয়া হবে। শিগগিরই প্রতিবেদন দাখিল করা হবে।
এদিকে, এ ঘটনায় চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের প্রশাসক খোরশেদুল আলম সুজন নড়েচড়ে বসেছেন। দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতির কথা জানিয়ে তিনি বলেন, আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর আইসোলেশন সেন্টারের খরচ ও কেনাকাটার বিষয়টি আমলে নিয়ে একটি তিন সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করেছি। সেখানে টেন্ডার ছাড়াই কিভাবে ৩-৪ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। গঠিত কমিটি তদন্তের কাজ ইতিমধ্যে অনেকটা সম্পন্ন করেছে। তদন্তের প্রমাণ পেলে কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ— টিআইবি চট্টগ্রাম মহানগরের সভাপতি এডভোকেট আখতার কবির চৌধুরীও বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, ‘সিটি কর্পোরেশনের আইসোলেশন সেন্টার করোনাকালীন জনপ্রতি রোগীর ২ লাখ ১৫ হাজার টাকা যে খরচ দেখিয়েছে, তা অবিশ্বাস্য। বাংলাদেশে স্বাস্থ্য সেবাখাতে এ ধরনের খরচের নজির খুব বেশি নেই। সিটি কর্পোরেশনের যারাই এ দায়িত্বের সঙ্গে জড়িত যথাযথ তদন্তের মাধ্যমে তাদের আইনের আওতায় আনার পাশাপাশি দুর্নীতি দমন কমিশনকে বিষয়টি আমলে নিয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান তিনি।