তুরাগ নদের তীরে শুক্রবার থেকে শুরু হচ্ছে ৫৫তম বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্ব। এদিকে ইজতেমাকে সামনে রেখে এখন লাখো মুসল্লির পদচারণায় মুখরিত হয়ে উঠছে তুরাগ নদের পূর্বতীর। এ উপলক্ষে শিল্পনগরী টঙ্গী সেজেছে নতুন সাজে। এরই মধ্যে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল ও বিদেশ থেকে তাবলিগ অনুসারি ধর্মপ্রাণ মুসল্লিরা ইজতেমা ময়দানে জড়ো হচ্ছেন। ১০ জানুয়ারি ইজতেমা শুরু হলেও বুধবার থেকেই ইজতেমা ময়দানে মুসল্লিরা দলে দলে আসতে শুরু করেছেন এবং নিজ নিজ খিত্তায় অবস্থান নিচ্ছেন।

জানা গেছে, শুক্রবার (১০ জানুয়ারি) বাদ ফজর আ’ম বয়ানের মধ্যদিয়ে অনানুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়ে ১২ জানুয়ারি জোহরের নামাজের আগে আখেরি মোনাজাতের মধ্যদিয়ে বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্বের সমাপ্তি ঘটবে। মাঝে চারদিন বিরতি দিয়ে ১৭ জানুয়ারি শুরু হয়ে ১৯ জানুয়ারি আখেরি মোনাজাতের মধ্যদিয়ে শেষ হবে দ্বিতীয় পর্ব। এরই মধ্যে ইজতেমার সার্বিক প্রস্তুতিরকাজ সম্পন্ন হয়েছে। ইজতেমা ময়দানে মুসল্লিদের অবাধ প্রবেশ নিশ্চিত করতে সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোরের সদস্যরা তুরাগ নদে ৭টি ভাসমান পন্টুন সেতু নিমার্ণ করেছেন। ১৬০ একর জমির ওপর নির্মিত সুবিশাল প্যান্ডেলের কাজ, খুঁটিতে নম্বর প্লেট, খিত্তা নম্বর, জুড়নেওয়ালি জামাতের কামরা, মুকাব্বির মঞ্চ, বয়ান মঞ্চ, তাশকিল কামরা, পাহাড়া ও এস্তেকবালের জামাত তৈরি, হালকা নম্বর বসানোর কাজ শেষ হয়েছে।

তবে ইসলামী সম্মেলনে নারী-পুরুষের সহঅবস্থান ইসলামী শরিয়ত বিধিসম্মত না হওয়ায় এদফার ইজতেমায় ময়দানে মাস্তুরাত (মহিলাদের) কামরা রাখা হয়নি। আগত নারী মুসল্লিরা ময়দানের চারপাশের বাসাবাড়িতে বসে মুরুব্বিদের বয়ান শুনতে পারবেন। আগত মুসল্লিদের সুষ্ঠুভাবে বয়ান শোনার জন্য পুরো ময়দানে শব্দ প্রতিধ্বনিরোধক প্রায় আড়াইশ বিশেষ ছাতা মাইক, ৫০টি ইউনিসেফ (প্রতিধ্বনি প্রতিরোধক) মাইকসহ প্রায় সাড়ে তিনশ’টি মাইক স্থাপন করা হয়েছে।
কাজাখাস্তানের মুসল্লি মোহাম্মেদ ডেনি বেক (৪৫) জানান, ইবাদত-বন্দেগীর মাধ্যমে মহান আল্লাহকে রাজি খুশি করাতেই টঙ্গীর ইজতেমা ময়দানে এসেছি।
এদিকে ময়মনসিংহ থেকে ১৫ সদস্যের এক জামাত নিয়ে এসেছেন আবুল কাশেম (৬২)। তিনি জানালেন ইজতেমা ময়দানের মুরুব্বিদের বয়ান শুনে হেদায়েতের পথ পাওয়ার জন্য এসেছি। নারায়ণগঞ্জ আড়াই হাজার এলাকার মুসল্লি আব্দুর রশিদ (৬৫) জামাতের সাথে তিন দিনের ইজতেমায় এসেছেন। আখেরি মোনাজাত শেষে চল্লিশ দিনের জন্য বের হবেন বলে জানিয়েছেন।

বিশ্ব ইজতেমা উপলক্ষে টঙ্গীতে আইনশৃংখলা জোরদার করা হয়েছে। পাচঁ সেক্টরে ভাগ করে তিন স্তুরের নিরাপত্তার লক্ষ্যে ইজতেমার ময়দানসহ আশপাশের এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। ইজতেমা মাঠের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আজ (বৃহস্পতিবার) থেকে প্রায় ৮ হাজার পুলিশসহ র্যাব, সাদা পোশাকধারী বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যদের মোতায়েন করা হবে। এছাড়া বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ময়দানে আগত মুসল্লিদের নিরাপত্তায় চারপাশে টহল দিবেন।
গাজীপুর ফায়ার সার্ভিসের জোন-২ এর উপ-সহকারী পরিচালক মো.মানিকুজ্জামান জানান, ইজতেমাস্থলে আমাদের একটি কন্ট্রোল রুম থাকবে। সেখানে সার্বক্ষণিক কর্মকর্তাসহ ফায়ারম্যানরা অবস্থান করবেন। ৬টি টু-হেলার মোটরসাইকেল টহল, ১৪ টি ফায়ার ফাইটিং ইউনিট, ১ টি ষ্ট্যান্ডবাই লাইটিং ইউনিট, ৬ টি মোবাইল জেনারেটর, প্রতি খিত্তায় ২জন ফায়ারম্যান থাকবে। এছাড়াও বিভিন্ন স্থানে ৩ টি পানিবাহী গাড়ি, ৩ সদস্যের ডুবুরি ইউনিট এবং ৩ টি অ্যাম্বুলেন্স, ১টি রেসকিউ বোর্ড, ১টি রেসকিউ গাড়ী থাকবে। ফায়ার সার্ভিসের ২০ জন কর্মকর্তাসহ ২৫০ কর্মী সার্বক্ষণিক উপস্থিত থাকবে।
টঙ্গী রেলওয়ে জংশনের ষ্টেশন মাস্টার মো. হালিমুজ্জামান জানান, এবারের বিশ্ব ইজতেমায় মুসল্লিদের সুষ্ঠু যাতায়াতের জন্য ১৬টি বিশেষ ট্রেন পরিচালনা করবে বাংলাদেশ রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। ১০ জানুয়ারি থেকে শুরু করে ১৯ জানুয়ারি পর্যন্ত ঢাকা অভিমুখী সব ট্রেন ৫মিনিট পর্যন্ত টঙ্গী ষ্টেশনের দাঁড়াবে। সাপ্তাহিক বন্ধের সকল ট্রেনও ওই সময়ে চলাচল করবে। এছাড়াও প্রতিটি ট্রেনে অতিরিক্ত বগি সংযোজন কার হচ্ছে।
টঙ্গী বিদ্যুৎ বিতরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. রায়হান আরেফিন জানান, ইজতেমার ময়দান ও আশপাশের এলাকায় সার্বক্ষণিক বিদ্যুৎ সরবরাহের সব প্রস্তুতি ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে। উত্তরা, টঙ্গী সুপার গ্রিড ও টঙ্গী নিউ গ্রিডকে বরাবরের মতোই মোট ১৩২ কেভি সোর্স হিসেবে নির্বাচন করা হয়েছে, যাতে করে একটি গ্রিড অকেজো হলেও বিদ্যুৎ সরবরাহ বিঘ্নিত না হয়। নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য সকল প্রকার ব্যবস্থা ইতোমধ্যে নেওয়া হয়েছে। এছাড়া ৪ টি ১১ কেভি ফিডার লাইন ও ২১ টি বিতরণ কেন্দ্র করা হয়েছে।
স্থানীয় ওয়াসা ও তিতাস গ্যাস কোম্পানি সূত্রে জানা গেছে, ইজতেমা ময়দানে ১৩টি গভীর নলকুপ স্থাপন করা হয়েছে। সাড়ে ১৮ কি.মি পাইপ লাইনের মাধ্যমে যা থেকে দৈনিক প্রতিদিন প্রায় ৩ কোটি ৫৪ লক্ষ গ্যালন সুপেয় পানি মুসল্লিদের মধ্যে সরবরাহ করা হবে। ময়দানের চারপাশে ৩০টি তিনতলা বিশিষ্ট ভবনে ৮ হাজার ৩শ ৩১টি পাকা ও প্রায় ৪শ’ অস্থায়ী কাঁচা পায়খানা তৈরিসহ প্রায় ৯ হাজার পায়খানা, গোসল ও অজুখানা তৈরি ও মেরামত করা হয়েছে। এছাড়া ওয়াসা কর্তৃপক্ষও তাদের গাড়ির মাধ্যমে বিভিন্ন স্থানে পানি সরবরাহ করবে।
ইজতেমায় আগত মুসল্লিদের চিকিৎসাসেবা প্রদানে প্রথম পর্বে ব্যাপক প্রস্তুতি বিষয়ে টঙ্গী সরকারি হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা: মাসুদ রানা বলেন, ‘টঙ্গী ৫০ শয্যা বিশিষ্ট সরকারি হাসপাতালকে ইজতেমার জন্য অস্থায়ীভাবে ১০০ শয্যায় উন্নীত করা হয়েছে। সেই সঙ্গে মুসল্লিদের স্বাস্থ্যসেবা নিয়ন্ত্রণের জন্য নিয়ন্ত্রণ কক্ষ এবং ১৪টি অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।
বিশ্ব ইজতেমার মিডিয়া সমন্বয়ক মুফতি জহির ইবনে মুসলিম বলেন, বুধবার সকালে বয়ান মঞ্চের পাশ থেকে ইজতেমা ময়দানে বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত সাথীদের উদ্দেশ্যে নজমের তারতীব ও হেদায়েতী বয়ান করেন মাওলানা রবিউল হক। তিনি সকল সাথীদেরকে তাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব পুরোপুরিভাবে পালনের আহ্বান জানান।
টঙ্গী পশ্চিম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. এমদাদুল হক জানান, টঙ্গীর আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি বিশেষ করে চুরি, ছিনতাই রোধসহ মাদক ক্রয়-বিক্রয় বন্ধ এবং এলাকার বিভিন্ন অপরাধমূলক কার্যক্রম বন্ধে বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। বিশ্ব ইজতেমায় আগত মুসল্লিদের নিরাপত্তা বিধানে ঢাকা ময়মনসিংহ মহাসড়কের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণস্থানে পর্যাপ্ত পরিমাণে সিসি ক্যামেরা স্থাপন করা হয়েছে।
গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর আলম বলেন, সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর, কর্মকর্তা ও কর্মচারিদের সমন্বয়ে ১৪টি কমিটি গঠনের মাধ্যমে সুনির্দিষ্টভাবে দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছে। বিশ্ব ইজতেমা ময়দান ও আশপাশের এলাকা দুর্গন্ধ ও রোগজীবানুমুক্ত রাখতে ৬০০ ড্রাম ব্লিচিং পাউডার ও দুই হাজার লিটার কেরোসিন ছিটানো হচ্ছে।