অনিশ্চয়তায় কমেছে খাদ্যশস্য আমদানি

বিশ্ববাজারে দুই-আড়াই মাসের ব্যবধানে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম কমতির দিকে। পণ্যভেদে ১৫-২০ শতাংশ থেকে ৪৮ শতাংশ পর্যন্ত কমেছে দাম। দাম কমলেও আমদানি কমিয়ে দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। দাম পড়তির দিকে থাকলেও স্থিতিশীল না হওয়া পর্যন্ত এমনিতেই আমদানি কম হয়। এখন এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ডলারের দামের অস্থিরতা। তাতে পণ্য বিক্রি করে আমদানি খরচ তুলে আনার নিশ্চয়তা পাচ্ছেন না ব্যবসায়ীরা।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, গত অর্থবছরে বিপুল পরিমাণ খাদ্যশস্যসহ নিত্যপণ্য আমদানি হয়েছে।

অনিশ্চয়তায় কমেছে খাদ্যশস্য আমদানি

 

দামের ঊর্ধ্বগতির কারণে দেশে চাহিদা ছিল কম। ফলে এখনই নিত্যপণ্যের সরবরাহে কোনো সমস্যা হচ্ছে না। তবে সংকটময় পরিস্থিতিতে সার্বক্ষণিক তদারকির কথা বলেছেন তাঁরা, যাতে সামনে কোনো সমস্যা না হয়।

আমদানি ও ঋণপত্রের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়,নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মধ্যে গমের আমদানি সবচেয়ে বেশি কমেছে।

আবার সরকার চালের দামের ঊর্ধ্বগতি ঠেকাতে গত ৩০ জুন প্রথম দফায় বেসরকারি খাতে চার লাখ টন আমদানির অনুমতি দিলেও এখন পর্যন্ত ১ শতাংশের বেশি আমদানি হয়নি। তবে অপরিশোধিত ভোজ্যতেল, সয়াবিন তেল উৎপাদনের কাঁচামাল সয়াবিন বীজ ও ডালের আমদানি স্বাভাবিক রয়েছে।

 

 

দাম কমার পরও আমদানি কমার কারণ জানতে চাইলে শীর্ষস্থানীয় খাদ্যশস্য আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান বিএসএম গ্রুপের চেয়ারম্যান আবুল বশর চৌধুরী চারটি কারণের কথা বলেছেন।

এক. ডলারের বিনিময়মূল্যের অনিশ্চয়তায় আমদানি খরচ ও বাজারমূল্যের হিসাব মেলানো যাচ্ছে না।

দুই. ডলার–সংকটে ব্যাংকগুলো ঋণপত্র খুলতে কিছুটা অনীহা।

তিন. বিশ্ববাজারে দাম কমার পরও ডলারের ঊর্ধ্বগতির জন্য স্থানীয় বাজারের চেয়ে আমদানি খরচ বেশি পড়ছে।

চার. ভারত রপ্তানি বন্ধের পর ইউক্রেনের বাজার খুললেও সেখান থেকে আমদানিতে অনিশ্চয়তা কাটেনি।

তবে আবুল বশর চৌধুরী মনে করেন, আমদানি কমলেও আতঙ্কের কিছুই নেই। কারণ, আগের আমদানির গম আছে। বাজারেও দাম কম। তাতে খুব শিগগির সংকট হবে না। তবে ভারত থেকে গম আমদানির জন্য সরকারি পর্যায়ে চেষ্টা চালানো দরকার বলে মনে করেন তিনি। এতে সামনে সরবরাহের পাশাপাশি প্রতিযোগিতামূলক দামে আমদানি করা যাবে।

অনিশ্চয়তায় কমেছে খাদ্যশস্য আমদানি

গত ১৩ মে ভারত রপ্তানি বন্ধের পর গমের আমদানি কমতে শুরু করে। এর প্রভাব পড়েছে মূলত জুন মাস থেকে। ২০২১ সালের জুন মাসে গম আমদানি হয়েছিল ৪ লাখ ১১ হাজার টন, এ বছর একই সময়ে আমদানি হয় ২ লাখ ১২ হাজার টন। আবার গত বছর জুলাই মাসের প্রথম ২৫ দিন আমদানি হয় ৩ লাখ ৬৪ হাজার টন, এ বছর একই সময়ে আমদানি হয় ১ লাখ ২১ হাজার টন। অর্থাৎ প্রায় দুই মাসের ব্যবধানে আমদানি কমেছে ৫৭ শতাংশ।

বছরখানেক আগেও দেশে চাহিদার ৪৫ শতাংশের মতো গম আমদানি হতো রাশিয়া-ইউক্রেন থেকে। ফেব্রুয়ারির শেষে যুদ্ধ শুরুর পর এই দুটি দেশ থেকে গম আমদানি বন্ধ হয়ে গেলেও সমস্যা হয়নি। কারণ, ভারতের বাজার খোলা থাকায় যুদ্ধের আগে থেকেই প্রতিবেশী দেশটি থেকে গম আমদানি হচ্ছিল।

ভারত রপ্তানি বন্ধ করে দেওয়ার পর প্রথম হোঁচট আসে এই খাদ্যশস্য আমদানিতে।

ভারত রপ্তানি বন্ধের পর ১৩ মে থেকে ১৪ জুলাই পর্যন্ত পাঁচ লাখ টন গম আমদানি হয়েছে। এর ৭৬ শতাংশই এসেছে ভারত থেকে, যেগুলো নিষেধাজ্ঞার আগে ঋণপত্র খোলা হয়েছে। ভারত রপ্তানি বন্ধের পর মূলত বিকল্প বাজার থেকে কম আমিষযুক্ত সাধারণ মানের গম আমদানি হয়নি।

গত শুক্রবার রাশিয়া-ইউক্রেন চুক্তির পর ইউক্রেন থেকে শস্য বা গম রপ্তানির সুযোগ তৈরি হয়।

তবে চুক্তির পরদিন ওদেসা বন্দরে হামলার পর অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।

অবশ্য ইউরোপের দেশগুলোতে এ ধরনের গমের ফলন উঠবে সামনে। ইউক্রেনের পাশাপাশি ইউরোপের দেশগুলো থেকে গম আমদানিতে খোঁজখবর নিচ্ছেন ব্যবসায়ীরা।

তবে ভারত রপ্তানি বন্ধের পর সেভাবে ঋণপত্র খোলা হচ্ছে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে, গত জুন মাসে গম আমদানির ঋণপত্র খোলা হয়েছে মাত্র ৫৫ হাজার টন। আর চলতি মাসের ১৬ জুলাই পর্যন্ত খোলা হয়েছে ৬৩ হাজার ৩০০ টনের।

ছোটখাটো আমদানিকারকেরা ভারত থেকে বিপুল পরিমাণে গম আমদানি করলেও বাজার বন্ধ হওয়ার পর তাঁরা নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছেন। এ রকমই একজন খাতুনগঞ্জের আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান নুরুল ইসলাম অ্যান্ড ব্রাদার্সের কর্ণধার মো. মুসলিম উদ্দিন।

তিনি জানান, ‘ছোট ছোট চালানে গম আমদানি করেছি। ভারত রপ্তানি বন্ধের পর আমদানি করতে পারছি না। কারণ, বিকল্প দেশ থেকে বড় চালানে গম আমদানি করতে হয়।’

সকালের নাশতা থেকে শুরু করে দিনে খাদ্যপণ্যের বড় অংশজুড়ে থাকে গমের তৈরি পণ্য। ধনী-গরিবের খাদ্যাভ্যাসে গমের তৈরি খাদ্যপণ্যের চাহিদা বেড়ে ৭০-৭৫ লাখ টনে উন্নীত হয়েছে। দেশে বছরে গড়ে ১১ লাখ টন গম উৎপাদিত হয়। চাহিদার বাকি গম আমদানি করে মেটানো হয়। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) হিসাবে, গত অর্থবছরে গম আমদানি হয়েছে ৬২ লাখ টন।

গম আমদানি কমে আসার সময় মজুত কমছে সরকারি গুদামেও। গত রোববার সরকারি গুদামে ১ লাখ ৫৯ হাজার টন গমের মজুত ছিল, যা গত বছরের চেয়ে কম। গত বছর একই সময়ে গমের মজুত ছিল ২ লাখ ৬০ হাজার টন। অবশ্য ভারতের বিকল্প দেশ থেকে সরকারিভাবে গম আমদানির প্রক্রিয়া চলছে বলে খাদ্যসচিব মো. ইসমাইল হোসেন জানিয়েছেন।

অনিশ্চয়তায় কমেছে খাদ্যশস্য আমদানি

বোরো মৌসুমে ফলন ওঠার পর দেশে চালের মজুত রয়েছে। এরপরও দামের ঊর্ধ্বগতির কারণে সরকার গত জুনের শেষে ৯৫টি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে চার লাখ টন চাল আমদানির অনুমতি দেয়। তবে এখন পর্যন্ত চার হাজার টনের বেশি চাল আমদানি হয়নি। আবার অনুমতি দেওয়া চাল ২১ জুলাইয়ের মধ্যেই ঋণপত্র খুলতে হবে। তবে ১৬ জুলাই পর্যন্ত চাল আমদানির ঋণপত্র খোলা হয়েছে ৪৪ হাজার টনের। অর্থাৎ সময়সীমার দুই–তৃতীয়াংশ পেরিয়ে যাওয়ার পর ১১ শতাংশ চাল আমদানির ঋণপত্র খোলা হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে দুই দফায় আরও ৬২ প্রতিষ্ঠানকে প্রায় এক লাখ টন চাল আমদানির অনুমতি দেওয়া হয় গত এক সপ্তাহে।

কেন আমদানি করছেন না—জানতে চাইলে চাল আমদানির অনুমতি পাওয়া চট্টগ্রামের চাক্তাইয়ের মনসা স্টোরের কর্ণধার ও চাক্তাই ধান চাল ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক ওমর আজম বলেন, ‘ডলারের দর বেড়ে যাওয়ায় চাল আমদানিতে খরচ বেড়ে গেছে। ডলারের দাম কোথায় ঠেকবে, তার নিশ্চয়তাও পাওয়া যাচ্ছে না। লোকসানের শঙ্কায় আমদানিতে সাহস পাচ্ছি না।’

চাহিদার তুলনায় চাল উৎপাদনে বড় ধরনের ঘাটতি না হলেও প্রতিবছর কমবেশি চাল আমদানি করতে হয়। রাজস্ব বোর্ডের হিসাবে, ২০২১-২২ অর্থবছরে সব ধরনের চাল আমদানি হয়েছে প্রায় ১০ লাখ টন, প্রায় সবই আমদানি হয়েছে ভারত থেকে। আবার সরকারি গুদামে চালের মজুত গত বছরের চেয়ে বেশি রয়েছে। সরকারি হিসাবে, ১৪ লাখ ৬৬ হাজার টন চালের মজুত রয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, চাল-গমের মতো প্রধান খাদ্যশস্যের আমদানি নিয়মিত তদারকি করা উচিত। এখন ডলারের বিনিময়মূল্য বাড়তে থাকায় ব্যবসায়ীরা আমদানিকে ঝুঁকি মনে করছেন। এ জন্য প্রয়োজনে প্রধান নিত্যপণ্য আমদানিতে ডলারের বিনিময়মূল্য নির্দিষ্ট করে বেসরকারি খাতে আমদানির নিশ্চয়তা দিতে পারে সরকার। সরকার নিজেও সরাসরি আমদানি বা ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে আমদানি করতে পারে।

 

 

খাদ্য খাদ্য

অস্ট্রেলিয়ার প্রথম হিজাব পরিহিতা সিনেটর হলেন আফগান তরুণী ফাতিমা

দাবিদার নেই ব্যাংকে পড়ে থাকা ৪৮ হাজার কোটি রুপির!

Leave A Reply

Your email address will not be published.